নবনীতা দেব সেন (১৯৩৮ – ২০১৯) পার্টনার-ইন-ক্রাইমেষু

এমন ব্যাকুল করে কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাসো ।।

দেখতে দেখতে দু’মাস হয়ে কেটে গেলো। আজ ১৩ জানুয়ারি আপনার জন্মদিন। বিরাশি বছরের। নতুন করে আর কীই বা বলতে পারি? বকের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, অঋণী আর অপ্রবাসী মাত্রে সুখী। ঋণের কথা জানি না। কিন্তু প্রবাস ও পরবাস অনেক কিছু কেড়ে নেয়। তার মধ্যে একটা হলো, যাকে চলতি কথায় বলে ক্লোজার এর সম্ভাবনা। যেদিন চলে গেলেন, কলকাতায় থাকলে হয়তো একপ্রকার সমাপ্তির বোধ তৈরি হতো। দূরদেশে কেবলই শূন্যতা। তখন সারারাত ঘুম হয় নি। তার পরের দিনেও কী করবো ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। তারপর ঠিক করলাম উপসালার ক্যাথিড্রালে গিয়ে একটা মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে আসি। তখন হঠাৎ মনে পড়লো, আদতে শেষমেশ সব কেমন যেন চক্রাকারে ফিরে আসে। তর্পন করতে এসেছি যে উপসালা ক্যাথিড্রালে, সেখানে তো এককালে আপনিও এসেছিলেন। ১৯৫০ সনে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়ানোর সময়। কবি নরেন্দ্র দেব সেকথা লিখেছেন তাঁর সাহেব বিবির দেশে। 

ভালোবাসার জোর ছিলো বলেই এমন মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন। সবসময় যে তার মান রাখতে পেরেছি তা নয়। তবে অক্টোবরে কলকাতায় যখন দেখা হলো, বারবার একটাই কথা বলছিলেন, “জানিস, পরের বার যখন আসবি তখন আর আমি থাকবো না।” গত বসন্তে কেউ কেউ চামড়ার রং তুলে খোঁটা দিয়েছিলেন বলে বহু মাস মনমরা হয়ে ছিলাম। নিকটজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে অহেতুক জটিলতায় ভরিয়ে তুলেছিলাম সব কিছু। আপনি তো সবই বুঝতেন। শেষ অবধি বোধ আর রসবোধ, দুটোই প্রখর ছিলো। অন্য কিছু জিগ্যেস করেননি আর; কেবল চলে যাবার তিন সপ্তাহ আগে যখন শেষবার দেখা হলো, চলে আসার আগে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, “সব স্বচ্ছ হয়ে যাক।” ছোট্ট একটা বাক্য। কিন্তু এমন স্পষ্ট কথা এমন সোচ্চার উচ্চারে আমায় আর কেউ বলবেন না। এই চিঠিটা তার আগেই লেখা। শেষ যেদিন দেখা হলো, সেদিন আপনাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। জন্মদিনে নাহয় আরেকবার পড়ে শোনাই! 

নবনীতা দেব সেন পার্টনার-ইন-ক্রাইমেষু,

২০০৭ সনে ধ্রুবপদ পত্রিকায় অঞ্জলি দাশের একটা লেখা বেরোয়। “গেছো মেয়ে বিদ্যাবতী”। আপনাকে নিয়েই লেখা। তখনও আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। আপনার সঙ্গে যতোদিনে আমার পরিচয় হয়েছে, প্রথাগত অর্থে আপনি আর তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান না। আর আপনার লেখায় যে পড়েছি, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গাছে চড়ার কথা, সেটাও আর তখন হওয়ার নয়। ফলে আমি যে গেছো মেয়ে আর বিদ্যাবতীকে দেখেছি তার রকমসকম একটু আলাদা। তারই দু-একটা গল্প বলি বরং। তাতে নিজের কথার ভাগ থাকবে হয়তো একটু বেশি। অনেকখানি কেবল আমি আর আমি। কিন্তু কী আর করা যাবে! ২০১৩ থেকে আমি দেশান্তরী। সামনাসামনি মোলাকাতের সুযোগ ঘটেছে কম। আপনার স্নেহের যে অফুরান ভাগ পেয়েছি, দূরে দূরে থেকেও, তা’ই হলো আমার গোষ্পদে জগৎদর্শনের সমান।

মনে আছে, ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের কথা? গেছো মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আমি গেছোদাদা হয়ে পৌঁছে গেছি আটলান্টিকের ও পারে। কলাম্বিয়ায় আপনার বক্তৃতার পরে সবাই খেতে গেছি এক ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয়। সঙ্গে গায়ত্রী স্পিভাক, টুম্পাদি, শ্রাবস্তীদি, আর আরও অনেকে। আমি বসেছি এক চিনে ছাত্রীর সঙ্গে। গায়ত্রী স্পিভাকের গবেষণা-সহকারী। স্নেহ-ভালোবাসা আর আদরে-প্রশ্রয়ে এতোদিন চিনেছি আপনাকে। আপনার কাছে সরাসরি ক্লাসরুমে বসে পড়ার সুযোগ হয়নি তো কোনওদিন। আদত বিদ্যেবতীকে চিনতে তাই অপেক্ষা করতে হলো সেদিন অবধি। দুনিয়ার পয়লা কাতারের বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার বক্তৃতার পরে শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস দেখলাম। খাওয়ার সময় আমার সামনে বসা ছাত্রীটি তাঁর মনের কথা বললেন। তিনি ভেবেছিলেন, নবনীতা দেব সেনও হয়তো কলাম্বিয়ায় বাকি যাঁরা বক্তৃতা দিতে আসেন, তাঁদেরই মতো কেউ হবেন। কিন্তু গায়ত্রী স্পিভাক যাঁর বক্তৃতার আগে আধঘন্টা ইন্ট্রোডাকশন দেন, তিনি না জানি কী!

কিন্তু স্নেহের ভাগ বেশি পড়লে মানুষী সম্পর্কের দিকটাই মনে থাকে বেশি। নিউ ইয়র্কের কথা ভাবলে আমার যে কথাটা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তা হলো আরেকরকম গেছো মেয়ের কথা। টুম্পাদির ব্রডওয়ের বাড়িতে রয়েছি। আমার স্ব-ভাব পেয়ে বসেছে আমায়। অনেক রান্না করছি সারাদিন। আপনি সে কথা অনেক যত্ন নিয়ে লিখেছেন। প্রতিদিন রোববার-এ, ৮ অক্টোবর ২০১৭য়। রান্না-খাওয়ার শেষে আমি অভ্যেসবশে রান্নাঘর পরিষ্কার করছি। আপনি ধমক দিলেন, “ছেড়ে দে। তুই কি জনের বাড়িতে জন খাটতে এসেছিস?” মুহূর্তে চমকে গেলাম। ভাষা নিয়ে আপনি যে এমন খেলতে পারেন, তা যাঁরা আপনার শব্দ পড়ে টাপুর টুপুর পড়েছে, তাঁরা সকলে জানেন। আপনাকে গাছে চড়তে দেখিনি বটে। তবে ভাষা নিয়ে ভাবতে গেলে আপনাকে চিরকালই গেছো মেয়ে মনে হয়েছে। আপনি বাংলা ভাষার গাছ রোদজল দিয়ে লালন করেছেন। সে গাছের অন্ধিসন্ধি জানেন আপনি। ‘জনের বাড়িতে জন খাটা’র মতো কথার খেলা খুঁজে পেয়েছেন সেই পথেই। আপনার কাছেই শোনা, আপনার কাকাবাবু আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গল্প। আপনি জিগ্যেস করেছিলেন, “কাকাবাবু, আপনি এতো ভাষা জানেন?” উনি উত্তর দিয়েছিলেন, “ভাষা তো জানি না; ভাষার ব্যাকরণ জানি বলতে পারো।” নবনীতাদি, অন্য ভাষার কথা জানি না; তবে বাংলার কথা বলতে পারি। আপনার থেকে এটুকু হয়তো শিখেছি, ব্যাকরণ থেকে উত্তরণের পরে ভাষায় পৌঁছোনোর পথটা বারবার বাৎলে দিয়েছেন আপনি। 

ভাষাকর্মী হিসেবে আমি আপনাকে কতোদিনই বা চিনি? অন্য গুরুজনেরা লিখেছেন, আপনাকে চিনতে সাহায্য করেছেন। নীরেনবাবুর কথা মনে পড়ছে। উনি বলেছেন, আপনার গদ্যভাষা “হালকা ফুরফুরে ঋজু টাটকা।” প্রত্যেকটি বিশেষণই অমোঘ। আমরা অনেকেই বড্ড বেশি কথা বলি। শুধু বেশি না, অকারণ বাজে কথা। নির্মোকহীনতার সাধনা সহজ নয়। ভাষার চলন  হালকা আর ফুরফুরে রেখেও ঋজু রাখার আদল শিখতে চেয়েছি আপনার কাছে। নীরেনবাবু তাই স্বজনসকাশের-র ভূমিকায় বলছেন, “বিশেষ করে তাঁর [নবনীতার] ছোটো মাপের সেইসব কবিতা পড়ে আমি চমকে যাই, আকারে ছোটো হলেও যা মস্ত মাপের এক-একটা ভাবনার দরজা একেবারে হাট করে খুলে দেয়। তখন ভাবি যে, বাস্‌ রে, যে-সত্যোক্তির আভাসটুকু দিতে আমাদের মতো পাকাঝুনো লেখকদের গাদাগুচ্ছের শব্দ খর্চা করতে হয় এবং তাতেও সেই কাজটা ঠিকমতো করে উঠতে পারি না, ইনি তো দেখছি শব্দ-প্রয়োগে এত মিতব্যয়ী হয়েও দিব্যি তার মর্মমূলে পৌঁছে যান।” সেরকম একটা কবিতা এখনই মনে পড়ছে।

চুল থেকে ওই শুকনো পাতার কুচি
তুইই তো ফেলে দিলি সেদিন পথে
এখন আমি শুকনো পাতার স্তূপে
অদৃশ্য – তুই কোথায়?

তবে এসব কিছু ছাপিয়ে আপনার কাছে আরেকটি বিপুল ঋণ রয়ে গেছে বাংলা ভাষার। আপনি না থাকলে আমরা বাংলা ভাষায় তপন রায়চৌধুরীর লেখা পেতাম না। রোমন্থন-এর ভূমিকায় অকুণ্ঠচিত্তে আর ওঁর স্বভাবসুলভ বাগবিস্তারে উনি সে কথা স্বীকার করে গেছেন। সে বইয়ের এমন অমোঘ আকর্ষণ যে দেশান্তরে যে মুলুকেই থাকি না কেন, রোমন্থন সঙ্গে থাকে আমার। দিনগত আকাদেমিক পাপক্ষয়ের মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ বাংলায় কিছু পড়তে শখ হলে, নিজের ভাষার অন্তর্লীন মজার প্রকোষ্ঠগুলোকে খুঁজে পেতে চাইলে বারবার ফিরে যাই ওই বইয়ের কাছে। আরেকটা বই সঙ্গে থাকে সবসময়। একই উদ্দেশ্যে। সেটার নাম শব্দ পড়ে টাপুর টুপুর। 

আবার নিজের কথা। শব্দ পড়ে টাপুর টুপুরের যে কপিটি আমার সঙ্গে থাকে সব সময়, ২০১৫-য় তার উপরের পাতে আপনি লিখে দিয়েছিলেন,

আদরের অর্ণব,
নিজেই নিজের পথ কেটে নিও
বিনয়ে, বিজয়ে ভরপুর
ঈশ্বরের করুণাবিন্দু
ঝরে যাক টাপুর টুপুর।

এখানে কয়েকটা কথা বলা দরকার, নবনীতাদি। আপনি ঠিকই লিখেছিলেন। করুণায় আস্থা আপনার অনির্বাণ। আপনার বিশ্বাস সতত নোঙর ফেলে রয়েছে ভালোবাসার বন্দরে। এই বিশ্বাস রয়েছে বলেই গভীর প্রতীতির সঙ্গে আপনি বলতে পারেন করুণাবিন্দু ঝরে পড়ার কথা। সেই কারণে আপনি বিজয়ের আগে বিনয়ের কথা লিখেছেন। ওটা আগুপিছু হয়ে যায় নি। কিন্তু কষ্ট হয় নবনীতাদি, এই প্রতীতি তো আমার নেই। আপনার কথার মান রাখতে পারি নি। হেরে গেছি। করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে-তে আপনি লিখেছিলেন, “সেমিনারে-টেমিনারে বক্তৃতা দিতে যাওয়া মানেই আরেক হাতা পাপ আঁচলের কোণে বেঁধে আনা।” আমারও সেই হাল হয়েছে, নবনীতাদি। বিজয় আর বিনয় আগুপিছু হয়ে ওলটপালট হয়ে গেছে। সারস্বতচর্চার হোরিখেলাতেও একরকম পুরীষপুষ্করিণী আছে। আপনি যখন করুণাবিন্দু ঝরে পড়ার কথা লিখেছিলেন, তখন সেটার কথা জানা ছিলো না। এখন কিছুটা প্রত্যক্ষ করেছি। শুধু হাতা নয়, গামলা গামলা পাপ বয়ে এনেছি আঁচলে আর বুকপকেটে। রোজকার বারকোশে সাজিয়ে রেখেছি সেই হেরে যাওয়া আর পাপের নৈবেদ্য। সেই কারণেই হয়তো করুণা আর কারুণ্য নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।

করুণার বহু অর্থ হওয়া সম্ভব। মনিয়ের-উইলিয়ামস ঘেঁটে দেখলাম। জ্ঞানেন্দ্রমোহন আর হরিচরণও। কমপ্যাশন আর এমপ্যাথির কথা আমাদের জানা। বৌদ্ধ দর্শনে আবার করুণার আরেকটু গভীরতর তাৎপর্য। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আপনি যেভাবে করুণার ব্যবহার করেছেন, সেই করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে থেকে শুরু করে, তাতে জ্ঞানেন্দ্রমোহন কথিত একটি সংজ্ঞা উপযুক্ত বলে মনে হয়। করুণার অর্থ মৈত্রী। তার মানে হয়তো মিতালির ইচ্ছা। দুনিয়াজোড়া হাটে-মাঠে-বাটে আপনি বন্ধুতার হাত পেতে দিয়েছেন। আমরা কেউ কেউ তার নাগাল পেয়েছি।  কেউ আবার নিজদোষে সেটা হেলায় হারিয়েছি। কিন্তু এই ভালোবাসার আর বন্ধুতার কথাটা সর্বাগ্রে মনে রাখা দরকার। ভ্রমণ সমগ্র-র ভূমিকায় আপনি লিখেছেন, “সর্বত্রই ঈশ্বর আমার জন্যে ভালোবাসার পাইক পেয়াদা মজুত করে রেখে দেন।” আমাদের কাছে আপনিই ভালোবাসার পাইক পেয়াদা। করুণার সহায়ে বহু যত্নে আগলে রেখেছেন আমাদের ঠুনকো ঘরদোর।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা খুব মনে পড়ছে। সেই ইউ ইয়র্কের ঘটনা। সন্ধে হয়ে আসছে। ঘরে আলো জ্বলেনি। টুম্পাদি আর জন গেছেন এক নেমন্তন্নে। শ্রাবস্তীদি গেছেন বাজারে। ক’দিন পরে আপনার কবিতাপাঠের আসর। আপনি তুমি মনস্থির করো থেকে একটা একটা করে কবিতা পড়ে যাচ্ছেন। আমি শুনছি আর স্টপওয়াচ ধরে সময়ের নিক্তি মেপে দেখছি আসল অনুষ্ঠানে আপনার বরাদ্দ সময়ে আপনি কী কী কবিতা পড়তে পারবেন। তখন প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে আপনি কয়েকটা অমোঘ কথা বলেছিলেন। সেগুলো আমার মনে এমন গভীর রেখাপাত করেছিলো যে আমি আমার নোটবুকে সেই রাতে সেটা লিখে রেখেছিলাম। “এই বয়েসে এসে বুঝতে পারছি, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাই না। যতো বয়েস হচ্ছে ততো মনে হচ্ছে এসব ইন্টেলেকচুয়াল কাজের কাজ কিছুটা হয়তো করতে হবে। কিন্তু এটা তোমার গোল নয়। এটা তোমার পন্থা। তাহলে ভাবছো, গোলটা কী? তা তো বলতে পারবো না।”

নীরেনবাবু স্বজনসকাশে-র ভূমিকায় তাই লিখেছিলেন, বার্ধ্যক্যে পৌঁছে ‘নির্মোকহীন স্বচ্ছ অন্তরলোক’ দেখার ক্ষমতা জন্মায়। আপনার সেদিনের কথায় আমারও সেরকমই মনে হয়েছিলো। আপনি ভালোবাসতে পেরেছেন, করুণার স্নিগ্ধতায় এতো মানুষকে আগলে রেখেছেন বলেই এমন দ্বিধাহীন, স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পেরেছেন, “ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাই না।” আপনার এই কথায় প্রতিধ্বনি পাই আচার্য সুনীতিকুমারের। আপনি আপনার কাকাবাবুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের কথা লিখেছেন “যা হারিয়ে যায়” নামের এক লেখায়। ওই লগ্নে উনিও প্রথাগত অনেক কিছুর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন বলে আপনি জানিয়েছেন। কিন্তু প্রজন্মান্তরে বাহিত স্নেহ আর ভালোবাসার প্রতি যে অগাধ বিশ্বাস ওঁর ‘হৃদয়ের অফুরান উষ্ণতা’য় জমা ছিলো তা নিউ ইয়র্কের সেই সন্ধ্যায় আমি আপনার কাছ থেকে পেয়েছি।

ভালোবাসার আর স্নেহের এই জোর আছে বলেই আপনার ভাষা এমন নির্মোকহীন আর ঋজু হতে পেরেছে। শব্দ তো আদতে এমন স্বচ্ছ নয়। সংসারে মন দিলে শব্দ আর মন হয়তো আবিল হয়। তার থেকে মুক্তি পেতেই রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন, “করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায় কাহারে […]।” আর আমি ভাবি আপনার একটি কবিতার কথা। আপনার কাছে এসে শব্দ স্বচ্ছ হয়ে যায়। 

দু’একটা মুখের সামনে দাঁড়াতে পারি না
মনে হয় মুখ ধোওয়া নেই
মনে হয় মুখে বুঝি ময়লা লেগে আছে
কোনো কোনো মুগ্ধ মুখ দর্পণের মতো স্বচ্ছ কিনা
দেখা যায় স্পষ্ট নিজেকেই –
নিজের চেয়েও বেশি কাছে। 

আপনি গেছো মেয়ে বিদ্যাবতী। ভাষার অন্ধিসন্ধি জানেন। ভাষার অতীত যদি কিছু থাকে, আমাদের অনেকের অকিঞ্চন জীবন করুণার প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিয়ে আপনি সেটুকুও জেনে নেন। আপনার কাছে লুকোবার কী আছে, বলুন? যে ক’জনের কাছে এলে নিজেকে নিজের চেয়েও স্পষ্ট দেখতে পাই, তার মধ্যে আপনি সর্বাগ্রগণ্যা। অকুণ্ঠচিত্তে বলতে পারি, আপনি না থাকলে অনেক কিছুই হতো না। আপনি পাশে না থাকলে আমার থিসিস লেখা হতো না। সেটা ছাপিয়ে আপনার হাতে তুলে দেওয়ার সময় মনের অন্তঃস্থল থেকে একটা বাক্য লিখতে পেরেছিলাম। এখানেও সেটার উল্লেখ করি

অজ্ঞানতিমিরান্ধ্যস্যজ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া
চক্ষুরুন্মীলিং যেন তস্মৈশ্রীগুরবে নমঃ

এখনও সব আঁধার কাটেনি। দেশ থেকে দেশান্তরী হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি। আঁচল ভরে বয়ে আনছি অনেক মনখারাপ আর পাপ। দৃঢ় ভেবেছিলাম, জ্ঞানের কাজলেই বুঝি চোখ ফুটবে। ফোটেনি। আপনার কাকাবাবু শেষবেলায় আপনাকে তার মোহভঙ্গের কথা বলেছিলেন। আপনি আমায় বলেছিলেন নিউ ইয়র্কের সেই সন্ধেয়। ভালোবাসা না দিলে আর ভালোবাসা না পেলে আঁধার কাটবে না। আপনি পথ দেখিয়েছেন। করুণার অঞ্জনই পাথেয়। পুণ্যবানে তার হদিশ জানে। কিন্তু আমার মতো অকিঞ্চনেও তার কিছুটা খোঁজ পেয়েছে আপনি ভালোবাসার পাইক পেয়াদা হয়ে আগলে রেখেছিলেন বলে। কোন সুকৃতির ফলে এতো স্নেহের ভাগ পেয়েছি, জানি না। তার মান রাখতে পারি নি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা কথা বলে শেষ করি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রের সংকলন ছাপানোর সময় অমিয় চক্রবর্তী ভূমিকায় লিখেছিলেন, “করুণায় মহীয়ান তাঁর প্রীতির ঘনিষ্ঠতা শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল।” আপনাকেও আমি এটুকুই বলতে চাই, আমি আপনার যোগ্য নাতি-ছাত্র হয়ে উঠতে পারলাম না। দৈবী আর মানুষী দুর্বিপাকে নীরব হয়ে গেছি। কথা বলার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছি। অনেক কথা হলো। অনেক কথা হওয়ার ছিলো। হলো না। সে আমারই অক্ষমতা। তাও আপনার ‘করুণায় মহীয়ান প্রীতির ঘনিষ্ঠতা’র আশিসটুকু আমার জীবনে অনাবিল বর্ষিত হোক, এটুকু ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই।

প্রণাম নেবেন।

অর্ণব

Leave a comment

search previous next tag category expand menu location phone mail time cart zoom edit close